সিরিজ টিউটরিয়ালের ৩য় পর্বে আপনাদের কে স্বাগতম। আশা করি আমাদের সকল টিউটরিয়াল গুলো মনোযোগ সহকারে পড়লে আপনি একজন টেকনিশিয়ান হিসাবে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন। এখন আপনাদের সাথে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো তা হল-কর্মস্থলে আপদ চিহ্নিতকরণ (Workplace Disaster Identification) তো চলুন শুরু করা যাক।
আপদ: খুব সহজ ভাবে বললে বলা যায় যার মাধ্যমে জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ বা পরিবেশের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে তাকে আপদ বলে।
যেমন: আগুন, বিদ্যুৎ, এসিড ইত্যাদি আমাদের উপকারে ব্যবহার হলেও হঠাৎ করে জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পদ বা পরিবেশের ক্ষতি করে বসতে পারে। তাই এদেরকে আপদ বলা হয়। প্রায় সব আপদই সুপ্ত অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে তবে একবার সক্রিয় হয়ে উঠলে মারাত্মক হতে পারে।
অতএব হ্যাজার্ড হলোঃ
- যখন কোন কিছু বা কোন বিষয় কোন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে বা ক্ষতির কারণ হয়।
- কোন বিষয় কোন সম্পদের/পরিবেশের ক্ষতি করে বা ক্ষতির কারণ হয়।
- উল্লেখিত উভয়ই ঘটতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে প্রধান প্রধান আপদ: কর্মক্ষেত্র সহ সকল জায়গায় মোটামোটিভাবে ৭ প্রকার আপদ লক্ষ করা যায়। যথা:
ক) বস্তুগত বা ফিজিক্যাল আপদ- বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট জড় বস্তু যেমন: ইট, পাথর, বালি, পেরেক, লৌহ খন্ড সহ যে কোন কিছুই দূর্ঘটনার কারন হতে পারে। তাই এগুলো আপদ বলে বিবেচিত।
খ) রাসায়নিক আপদ- যে কোন রাসায়নিক পদার্থ বা রাসায়নিক বিক্রিয়া যেমন: এসিড, পেট্রোল, থিনার, আগুন এ সকল কিছুই দূর্ঘটনার কারন হতে পারে এজন্যই আপদ হিসাবে বিবেচিত।
গ) অনুজীব ও জীবাণু আপদ- নোংরা স্থান ও বাসি পচা খাবারে বসবাসকারি অনুজীব যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যামিবা, এন্টামিবা, ভাইরাস এ সব কিছু মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে বিধায় আপদ হিসাবে বিবেচিত। বিভিন্ন রোগ যেমন: ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত ব্যাক্তি তার কফ, হাঁচি, থুথু যেখানে সেখানে ফেললে রোগের জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পরে। ফলে পাশে বসা কোন সুস্থ্য মানুষের নাক বা মুখ দিয়ে এ জীবানু শরীরে প্রবেশের ফলে রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। এ জীবাণু গুলো কোন তলের উপর যেমন: টেবিল, দরজার লক, যন্ত্রপাতির হাতল, টাকা প্রভৃতির উপর ২ ঘন্টা বা তার বেশি সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। তাই রোগে আক্রান্ত কোন ব্যাক্তি হাত দিয়ে তার নাক পরিস্কার করে অথবা মুখে হাত দিয়ে হাঁচি ফেলে সেই হাতে যা স্পর্শ করবে তাতেই জীবাণু লেগে যাবে এবং সুস্থ্য শরীরে জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটবে।
ঘ) মনস্তাত্বিক আপদ-মানসিক চাপ দূর্ঘটনার কারন হতে পারে বিধায় মানসিক চাপ মনস্তাত্বিক আপদ। প্রচন্ড কাজের চাপ, পারিবারিক অশান্তি বা পীড়নদায়ক পরিবেশ প্রভৃতি কারনে মানসিক চাপ বাড়তে পারে।
ঙ) বিকির্ণ রশ্মি বা রেডিয়েশন আপদ- ওয়েল্ডিং মেশিন থেকে এক ধরনের রশ্মি নির্গত হয় যা চোখের সাময়িক ক্ষতি সহ স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। ইহা বিকির্ণ রশ্মি বা রেডিয়েশন আপদের উদাহরণ।
চ) নয়েজ ও ভাইব্রেশন আপদ- বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, শীটমেটাল ওয়ার্কশপ এবং কলকারখানার যন্ত্রপাতি ও মেশিন থেকে প্রচন্ড শব্দ নির্গত হয়। এ শব্দ মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং শ্রবণ শক্তিকে লোপ করতে পারে। আবার মনুষ্য সৃষ্ট গোলমাল হৈ চৈ হঠাৎ কোন কর্মীকে অমনোযোগী করতে পারে যা দূর্ঘটনার কারন হতে পারে।
ছ) আর্গোনোমিক হ্যাজার্ড: যখন শরীরের মাংশপেশী একই ধরনের স্ট্রেচ পায় কিন্তু তা পূরন হওয়ার মত সময় পায়না তখন সে স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যে পরিস্থিতি এমনটা তৈরী করে তাই আর্গোনোমিক হ্যাজার্ড। যেমন সারাক্ষণ একইভাবে একই অবস্থানে কাজ করা। এই একই অবস্থানে কাজ করার দরুন শরীরের মাংসপেশী ও হাড়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয় তাই আর্গোনোমোকি হ্যাজার্ড। এই হ্যাজার্ডের ফলে মাংসপেশী, হাড়, ব্লাড ভেসেলস, নার্ভ ও অন্যান্য টিস্যুতে আঘাত ও ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং এ ক্ষতের কারনে ব্যাথা হয় এমনকি স্থায়ী পঙ্গুও হতে পারে।
জ) যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক আপদ: বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও মেশিনারীর ঘুর্ণায়মান অংশের মাধ্যমে কর্মী আহত হতে পারে। তাই এগুলো আপদ। আবার বিদ্যুৎ একটি আপদ। কারন বৈদ্যুতিক শক পেলে মানুষ আহত কিংবা মারা পর্যন্ত যেতে পারে।
আপদ নিয়ন্ত্রণ: আপদ নিয়ন্ত্রণ বলতে বিভিন্ন বস্তুগত বা ফিজিক্যাল, রাসায়নিক, জীবাণু, মনস্তাত্বিক, রেডিয়েশন, নয়েজ অথবা ভাইব্রেশন আপদ যেন দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা এবং দূর্ঘটনা ঘটলেও শ্রমিক কর্মীদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থাকে বুঝায়।
পরিস্থিতি বা কোন বস্তু আপদময় হয়ে ওঠার কারন:
১. নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে না রাখলে যে কোন বস্তুই আপদ হতে পারে।
২. অপরিকল্পিত কাজ করলে আপদ সৃষ্টি হতে পারে।
৩. অতিরিক্ত কাজ, মানসিক চাপ, অন্য মনস্কতা আপদ সৃষ্টি করতে পারে।
৪. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ পরিবেশের উপাদান গুলোকে আপদময় করে তুলতে পারে।
৫. নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার না করলে বস্তু, পরিস্থিতি, রেডিয়েশন, শব্দ সবই আপদময় হতে পারে।
আপদ নিয়ন্ত্রণের প্রধান প্রধান উপায়:
আপদ নিয়ন্ত্রণের প্রধান প্রধান উপায় গুলো নিন্মরুপ-
১. আপদকে কর্মস্থল থেকে দূর করা।
২. আপদকে নিরাপদ বস্তু বা কৌশল দ্বারা প্রতিস্থাপন।
৩. প্রকৌশলগত ব্যবস্থা- প্লান্ট, যন্ত্রপাতি, ভেন্টিলেশন পদ্ধতি অথবা কার্য প্রক্রিয়ার এমন ভাবে পরিবর্তন ঘটানো যাতে করে দূর্ঘটনা হ্রাস পায়।
৪. প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ- শ্রমিক কর্মীদের শ্রম ঘন্টা পরিবর্তন, কাজের নীতি, কলা কৌশল ও অন্যান্য নিয়ম কানুন
এমন ভাবে পরিবর্তন করা যাতে করে দূর্ঘটনা হ্রাস পায়। এছাড়াও শ্রমিকদের নিরাপদে মেশিন অপারেটিং করা, হাইজ কিপিং, যন্ত্রপাতির রক্ষনাবেক্ষণ এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ।
৫. প্রদানের মাধ্যমেও আপদ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৬. শ্রমিক কর্মীদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
আপদ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সাধারণত নিন্মোক্ত স্থলে প্রয়োগ করা হয়:
১. আপদের উৎস স্থলে (যেখান থেকে আপদ আসে বা যেখানে আপদ অবস্থান করে)।
২. আপদ চলাচলের পথে ( যে পথ দিয়ে আপদ চলাচল করে)।
৩. কর্মীর কাছে বা দেহে। (যেমন: পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট)।
এখন এই পর্যন্ত এটি একটি সিরিজ টিউটরিয়াল তাই বাকী অংশ পড়ুন পরের পোষ্টে।
পূর্বের লেখা পড়তে ক্লিক করুন-একজন ইঞ্জিনিয়ার বা ইলেকট্রিশিয়ানের নির্মাণ সেক্টরে বৈদ্যুতিক কাজ
পরবর্তী লেখা পড়তে ক্লিক করুন-তড়িতাহত বা বৈদ্যুতিক শক (Electric shock) পেলে করণীয়
One comment
Pingback: তড়িতাহত বা বৈদ্যুতিক শক (Electric shock) পেলে করণীয়